Pages

Saturday, August 04, 2018

তারুণ্যের জন্য

গত কয়দিন ধরে দেশের কিশোর-তরুণেরা যা দেখালো, তা এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। অকর্মণ্য প্রবীণ, জ্ঞানপাপী সুশীল ও ভীতু মধ্যবিত্তদের নিষ্ক্রিয়তা (কিছু ক্ষেত্রে উস্কানি) ও ব্যর্থতায় বহু বছর ধরে জমতে থাকা কলঙ্ক মুছতে রাস্তায় নেমে এসেছে সংখ্যাতীত স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী। নিজ হাতে তিলে তিলে ঠিক করছে ট্রাফিকের অনিয়ম, পুলিশের দূর্নীতি আর আমাদের কমনসেন্স। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী! চিন্তা করা যায়!
এক ধরনের নষ্ট রাজনীতিতে জর্জরিত বাংলাদেশ অনেক বছর ধরেই। চোখের সামনেই প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা প্রচুর অনিয়ম, অপরাধ এবং অপরাধীদের বিনা বিচারে ছাড় পেয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে আমাদের চোখের পর্দা পুরু হয়ে গেছে। অনেক কিছুই আমরা সহজাত ভাবেই মেনে নেই। “আরে, এ দেশে আর কি ই বা হবে”, “এটাই তো হওয়ার ছিল” ইত্যাদি। এই মেনে নেওয়া বা দেখে না দেখার ভান করা বৃহৎ অর্থে আবার এই অপরাধ ও দূর্নীতিগুলাকেই প্রশ্রয় দেয়, বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। এই জন্যই লঞ্চডুবির পর আমাদের সান্ত্বনা শুনতে হয়, “আল্লাহর মাল আল্লাহই নিয়ে গেছে”। অথচ এই তরুণরাই আমাদের দেখিয়ে দিল সবকিছু মেনে নেওয়া যাবে না। ২ জনের মৃত্যুসংবাদ শুনে হাসতে থাকা শাজাহানের হাসির দাতভাঙ্গা জবাব এই বিস্ময়কর আন্দোলন, যেই হাসির অর্থ হল, জনগন মরুক বাচুক আমার কিছু যায় আসে না।
অস্বাস্থ্যকর, অসভ্য রাজনীতির কারণে এই দেশে ‘আন্দোলন’ কথাটাও অনেকটা গুরুত্ব হারিয়েছে। এক দলের স্বার্থের জন্য অন্য দলের বিরুদ্ধে সকাল, বিকাল, ঈদের পর আন্দোলন প্রতিনিয়ত ঘটনা। যেহেতু সুস্থ আন্দোলন বিরল, এবং আন্দোলন কেবলই সচরাচর দেখা যায় পলিটিকাল গেইন এর জন্য, তাই এই আন্দোলন গুলা দমন করতেও ব্যবহার করা হত অমানবিক ও পাশবিক পন্থা। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের গুণ্ডারাই যার সিংহভাগ সম্পাদন করত। মোদ্দা কথা আন্দোলন ব্যাপারটার সাথেই একটা নেতিবাচক ‘স্টিগমা’ জড়িত। অর্থাৎ আন্দোলন করা মানেই মার খাওয়া, কেস খাওয়া, হুমকি খাওয়া ইত্যাদি। যার ফলস্বরুপ আমরা হয়ে উঠেছি ভীতু এক জাতি। এই অবস্থা থেকে আমাদের অনেকটা বের করে এনেছে তরুণ-কিশোরদের এই অভিনব প্রতিবাদ। চিন্তা করে দেখুন, বাবা মা ছেলেমেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছে। একটা স্বুস্থ প্রতিবাদে সামিল হয়ার সৎসাহস ফিরিয়ে দিল তরুনেরা। অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে রাস্তায় নেমে আস্তে হয় আমরা যেন ভুলেই গেছিলাম!
যে সাহস নিয়ে তরুনরা কাজগুলা করছে তা সর্বোচ্চ প্রশংসনীয়। ওদের মত শিরদাঁড়া আমার আপনার কারও নাই। পুলিশের লাঠি, গুন্ডার চোখরাঙানী এবং কতিপয় শিক্ষকের(!) থ্রেট উপেক্ষা করে, রোদ বৃষ্টির বালাই না করেই তারা প্রতিবাদ করেই যাচ্ছে। নিজেরাই ট্রাফিক একদম লাইনে নিয়ে আসছে, রাস্তা পরিষ্কার করছে এবং কোথাও কোথাও রাস্তা মেরামতও করছে। এই অদম্য স্পৃহা সত্যিই সাহস জোগায়, বিশ্বাস জোগায়, পরিবর্তন সম্ভব।
পুরা আন্দোলন জুড়ে দেখা গেল অভিনব কিছু দৃশ্য, যা বাঙ্গালী হয়ে আমরা এই দেশে দেখতে পাবো কখনও আশা করিনি। এক কিশোর রাস্তায় পা বিছিয়ে বসে আছে, যাতে রিক্সাগুলা সিঙ্গেল লাইনে যায়, হয় সিঙ্গেল লাইনে যাবে, অথবা অর পায়ের ওপর দিয়ে। ছেলেমেয়ে আন্দোলন করছে আর অভিভাবক রা পাশে বসে আছে, তারাও স্লোগান দিচ্ছে, গামলা ভর্তি খিচুড়ি রান্না করে এনে এক মা নিজ হাতে তাঁর ছেলে ও ছেলের বন্ধুদের খাইয়ে দিচ্ছে, যারা কিনা আন্দোলনে ব্যস্ত। দিনভর আন্দোলনের পর রাতে যখন কিশোররা চলে যাচ্ছে, তখনও, রাতের বেলা কী সুন্দর ট্রাফিক আইন মেনে যানবাহন চলছে! এক পুলিশ লাইসেন্স ছাড়া গাড়ী চালানোর অপরাধে আরেক পুলিশকে মামলা দিচ্ছে, সার্জেন্ট নিজের নামেই মামলা দিচ্ছে, এ এক অভিনব দৃশ্য!
অর্থাৎ নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলনে নেমে এই বাচ্চাকাচ্চা গুলো রীতিমত বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে! দাবি আদায় হওয়া, আন্দোলন সফল হওয়া কিংবা অপরাধীর শাস্তি হওয়াটা বিপ্লব না, আসল বিপ্লবটা হল প্রতিনিয়ত আরাম আয়েশ ও কনভিনিয়েন্সের লেন্স ছেড়ে দিয়ে বীভৎস বাস্তবতা টা কে দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে পারা! অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে চিৎকার করে স্লোগানে স্লোগানে শোষকের রক্ত ঠান্ডা করে দিতে হবে এইটা শেখাতে পারা! বিপ্লব মানে নতুনভাবে ভাবতে শেখানো। শুধু তাই নয়, গত কয়েকদিনে আমাদের আরো কয়েক জোড়া বাড়তি চোখ ও গজিয়েছে। আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব নিকাশ বুঝি না, তবে এই আন্দোলন যে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে তা অস্বীকার করা যাবে না। সেই অর্থে এই আন্দোলন একেবারেই সফল। চিন্তা করা যায়, একটা শহরকে রীতিমত পরিবর্তন করে ফেলেছে ইউনিফর্ম পরা, ব্যাগ ঘাড়ে নেওয়া একদল ছেলেমেয়ে! অবিস্মরনীয়!
সারাটা জীবন সমাজের বুড়াদের কাছে শুনে আসলাম ‘এখনকার’ ছেলেমেদের যত্তসব দোষত্রুটি গুলা। উনারা আমার জেনারেশন নিয়েই কত কথা বলেছে, আমার পরবর্তি জেনারেশন তো কোন ছাড়। আমার সবসময় উনাদের বলতে ইচ্ছা করত, জী জনাব আমাদের জেনারেশন শুধু কঙ্কাল আলা গেঞ্জিই পরে, কিন্তু এই যে এতদিন ধরে গদিতে বসে বসে আপনার জেনারেশন যে দেশটাকে বেঁচে খেল (এবং এখনও খাচ্ছে) তাঁর কি? এই সব অকর্মণ্য বুড়া ভাড়দের জন্য আজীবনের মত জবাব হয়ে থাকবে এই আন্দোলনটা, দেশের নানাবিধ সমস্যায় নাক সিটকে যারা টক শোতে চলে যায়।
প্রিয় ছোট ভাই বোনেরা যারা আন্দোলনে আছ, জেনে রাখ তোমরা যা করে দেখাচ্ছ তা এক দৃষ্টান্ত বটে। তোমাদের প্রতি অশেষ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা। তোমাদের সাহসের প্রতি সালাম। জেনে রেখ এই দেশটা তোমাদেরই, ছাত্রদের। স্বাধীনতার উত্তরাধিকার ছাত্রদেরই। নষ্ট বুড়া ভাঁড়দের নয়। সালাম-রফিকের বংশধর তোমরা। তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে প্রমান করেছ। ভয় তোমাদের নাই এটা সবাই দেখছে। তোমাদের দমাতে যাদের লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে তারা তোমাদের কেনি আঙ্গুল পর্যন্ত হতে পারবে না কয়েক জনমেও। যে শিক্ষক তোমাদের ভয় দেখাচ্ছে নানাভাবে এরা সারাজীবনেও তোমাদের কাছে সৎসাহস শিখতে পারবে না। কোন কলুষতা তোমাদের ছুতে দিয়ো না। আন্দোলনের ফলাফল যা ই হোক না কেন, তোমরা সবাই এক একটা জীবন্ত দৃষ্টান্ত, কীভাবে ঘুরে দাড়াতে হয় তার। ছাত্রদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সাহায্য করছেন যারা (অভিভাবক, কিছু পুলিশ, কিছু শিক্ষক) আপনাদের মত কিছু মানুষ আছে বলেই এখনো স্বপ্ন দেখতে ভাল লাগে।
পরিশেষে একটা কথা বলে শেষ করি। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, “Curiosity killed the cat”। অর্থাৎ কিনা অজানাকে জানার স্পৃহাই বিড়ালের(বা যে কারো) মৃত্যুর কারণ । যখনই নতুন কিছু নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে চায়, বা নতুন কিছু করতে চায়, বা নতুনভাবে ভাবতে চায়, তাদেরকে এই প্রবাদটি শোনানো হয় নিরুৎসাহিত করার জন্য। অথচ অনেকেরই যেটা জানা নাই, তা হল এই প্রবাদটির পুরোটা। পুরোটা এরকম – “curiosity killed the cat, but satisfaction brought it back”। অর্থাৎ অজানাকে জানার জন্য বিড়ালের মৃত্যু হলেও, অজানাকে জানতে পারাটা তাকে নতুন জীবন দান করে।
*আরো একটা প্রবাদ, অনেকেরই হয়ত জানা আছে – “Never tickle a sleeping dragon”
মাহাতাব ও ঈশার তৈরী ব্যানার

No comments:

Post a Comment