কয়দিন আগে ইউটিউব ঘাটতে ঘাটতে একটা মিউজিক্যাল প্রজেক্টের সন্ধান পেলাম।
“The Caretaker - Everywhere At The End Of Time”। ৬টা পার্ট বা অ্যালবামে বিভক্ত, পুরাটার স্থায়ীত্বকাল ৬ ঘন্টা ৩০ মিনিট।
এইটার ব্যাপারে বলার সময় সবাইকে উদাহরণস্বরূপ আরেকটা ছবির কথা বলতে শোনা যায়। এই ছবিটা।
এই ছবিটাতে কি কি আছে বলতে হবে। সোজা কাজ। একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
কিন্তু পারবেন না। এমন না যে ছবিটা আপনার পরিচিত না, প্রথম দেখাতে ধরেই নিয়েছেন একটা অগোছালো কর্নার এর ছবি। কিন্তু যেই পিনপয়েন্ট করতে গেছেন কোনটা কি, আর পারেননি। খুবই আলোচিত একটা ছবি। অনেকের ধারণা মানুষ স্ট্রোক করলে কেমন অনুভব করে তার একটা সিমুলেশন এইটা। ব্রেইন এর কাছে সবকিছু এতটুকু পরিচিত লাগে, যাতে একজন বুঝতে পারে সে বেঁচে আছে, কিন্তু কোনকিছুই চিনতে পারে না ঠিকমত। তবে ছবিটা যিনি তৈরি করেছেন তাঁর দাবি তিনি শুধুই জোক হিসেবে ছবিটি তৈরি করেছেন, artbreeder নামের একটা ওয়েবসাইট দিয়ে।
কিন্তু আসলেই একজন স্ট্রোক করে থাকা ব্যাক্তি বা এমন একজন যার স্মৃতিশক্তি ঠিকমত কাজ করছে না, তাঁর কাছে দুনিয়াটা কেমন হবে? এই প্রশ্নটার একধরনের মিউজিক্যাল সুরাহা হল “Everywhere At The End Of Time” প্রজেক্টটি। ইংলিশ ইলেকট্রনিক মিউজিশিয়ান James Leyland Kirby এর লং রানিং প্রজেক্ট হল The Caretaker, যেখানে তিনি মেমোরি লস, আলঝেইমার্স, ডিমেনশিয়া নিয়ে কাজ করে থাকেন। এর মধ্যে ফাইনাল প্রজেক্টটি হল Everywhere At The End Of Time, যার পুরাটা একটা যাত্রা। মেমোরি লস এর প্রত্যেকটা স্তর, মিউজিক্যালি এখানে দেখানো হয়েছে। সাথে আছে শিল্পী Ivan Seal এর একদম যথাযথ কভার আর্ট।
অ্যালবাম আর্ট গুলাও মিউজিকের মতই, এবং উপরে যে ছবিটার উদাহরণ দিলাম, অনেকটা তার মত। একটা আবছা ধারণা ঠিক পাওয়া যায়, আর্টওয়ার্কের বস্তুগুলো কি, কিন্তু কখনোই পুরাটা বুঝা যাবে না, স্মৃতি থেকে পুরাটা কিছুতেই উদ্ধার করা যাবে না। অনেকটা William Utermohlen এর এক্সপেরিমেন্ট এর মত। উনার আলঝেইমার্স ধরা পরার পর উনি ঠিক করেন প্রতি বছর আয়না দেখে নিজের একটা করে সেলফ-পোর্ট্রেট আকবেন। বছরের পর বছর পোর্ট্রেইটগুলি বিমুর্ত হতে থাকে, এক পর্যায়ে যেয়ে উনি আয়নায় নিজেকেই আর চিনতে পারেন না, বাস্তবতার উপর আর উনার সামাল থাকে না, যা তার পোর্ট্রেট এ ফুটে উঠে। খুব করুণ এই এক্সপেরিমেন্টটি “A Persistence of Memory” লিখে সার্চ দিলেই খুজে পাওয়া যাবে।
মানব মস্তিষ্কের শ্রবণসাধ্য ক্ষয়, ধীর মৃত্যু...
(আমি সঙ্গীত শব্দটা ব্যবহার করছি না, প্রচলিত ধারণা থেকে একটু দুরত্ব তৈরি করতে)
প্রজেক্টের ৬ টা পার্ট এর ছোট্ট একটা বর্ণনা তুলে ধরলাম, তবে পড়ার সাথে সাথে এটাকে এক্সপেরিয়েন্স ও করতে হবে, নীচে লিঙ্ক দেয়া আছে।
১ম পার্টঃ
মনে হবে পুরানো রেকর্ড বাজছে, অনেকটা লো ফিডেলিটি, কিছু নয়েজ আর ক্র্যাক এখানে সেখানে (অথচ পুরাটা কিন্তু ডিজিটালি তৈরি করা। ট্যালেন্ট!)। খুব একটা অপিরিচিত কিছু না। স্বপ্নের হারানো দিনগুলির মত। কোথায় যেন নস্টালজিয়ার সামান্য ছাপ আছে। ভালো দিনগুলোর শেষদিক। ডিমেনশিয়ার প্রথম স্তর। স্মৃতিগুলো ঠিকই আছে, এখানে সেখানে দু একটা জিনিস যেন মনে করতে সমস্যা হয়।
২য় পার্টঃ
হোয়াইট নয়েজ। মিউজেকের উপর যেন ধুলার আস্তরন পড়া শুরু করেছে। তাও মিউজিকটা শোনা যাচ্ছে। বোঝাও যাচ্ছে এটা মিউজিক। ডিস্টরশান আর নয়েজ বেড়ে গেছে। কোথাও অনেক নয়েজ এর পর মিউজিক শুরু হয়, যেন অনেক যুদ্ধ করে কিছু একটা স্মৃতি খুঁড়ে বের করে আনা। ডিমেনশিয়ার ২য় স্তর। কিছুটা কনফিউজিং। নিজের সাথে যুদ্ধ করা চিনে উঠার জন্য। কোথাও যেন একটা সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু সেটা স্বীকার করে নেয়া যাচ্ছে না। মিউজিক যে ঠিকই বাজছে! এক মিথ্যা আশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
৩য় পার্টঃ
স্মৃতিগুলার শেষ হাতছানি। মিউজিক গুলো যেন প্যাঁচ লেগে গেছে, জট বেধে গেছে। আগে কোথাও শোনা হয়েছে হয়ত? হতে পারে। কোন একটা শব্দ আলাদাভাবে চেনা যাচ্ছে না, সব মিশে যাচ্ছে। মিউজিকটা মাঝে মাঝে দূর কোন যায়গা থেকে ভেসে আসছে মনে হয়। কোথাও মনে হবে মিউজিক গুলা টেনে স্ট্রেচ করা হয়েছে পাতলা হয়ে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। ডিমেনশিয়ার ৩য় স্তর। এলোমেলো জট বাঁধা স্মৃতি, স্মৃতি না, স্মৃতির টুকরা। চেতনার ও সুসঙ্গতির ধীর বিদায়।
৪র্থ পার্টঃ
নয়েজ আর ডিস্টরশান মিউজিককে ছাপিয়ে উঠেছে। কনফিউশান বেড়ে গেছে। সাথে সময়ও। কোন ইন্সট্রুমেন্ট ঠিকমত চেনা যাচ্ছে না এমন সব অশরীরি শব্দ। কোন কিছু নির্দিষ্ট করে বলার ক্ষমতা যেন হারিয়ে গেছে। ডিমেনশিয়ার ৪র্থ স্তর।
৫ম পার্টঃ
বিভ্রান্তি, ভীতি। স্মৃতিগুলো মনে করতে চাওয়ার শেষ আর্তনাদ। প্যাঁচগুলা আরও প্যাঁচ খাচ্ছে, জটগুলা জেঁকে বসছে। মিউজিক বলে আলাদা কিছু নাই। অনেকগুলা বিচ্ছিন্ন অপরিচিত শব্দ একসাথে চিৎকার করার চেষ্টা করছে। একটার উপর দিয়ে আরেকটা। কোথা থেকে আসলো এই শব্দগুলো? ইন্সট্রুমেন্ট? না একসময় যা ইন্সট্রুমেন্ট ছিল তা থেকে? নাকি তারা সবসময় এই শব্দগুলোই করে আসতো? এই শব্দগুলা কি আগে কোথাও শোনা হয়েছে? এই স্মৃতিগুলো আদৌ কখনো ছিল? ডিমেনশিয়ার ৫ম স্তর।
৬ষ্ঠ পার্টঃ
শুণ্যতা। বাস্তবতার কোন চিহ্ন নাই। পুরু, ভারী একটা শব্দের প্রাচীর। শুন্যতার আছড়ে পরা ঢেউ। তার পর আরও শুন্যতা। সবকিছু মুছে ফেলা ঝড়। আর শুন্যতার নিষ্ঠুর সুখ।
ডিমেনশিয়ার শেষ পরিনতি।
ক্ষয়, মৃত্যু।
এইটা আমার কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী মিউজিক্যাল এক্সপেরিয়েন্সগুলার একটি। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবার মত। খুব কম শিল্প আছে যা এত সংখ্যক মানুষের উপর এত রোমহর্ষক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে মানবজীবনের বিমূর্ত ও অব্যক্ত ধারণা ও সমস্যাগুলো তুলে ধরা ও বাকীদের ‘অনুভব’ করানোর যে ক্ষমতা আছে তার যথার্থ উদাহরণ এইটা। আমার নানু শেষ জীবনে মেমোরি লসের মধ্যে দিয়ে গেছেন। প্রতিটা স্তরের মিউজিক্যাল বর্ননা যেমন দেয়া হয়েছে, একদম ওইরকম!
a slow decay and decline into nothingness
-----------------------------------------------------------
প্রয়োজনীয় লিঙ্কগুলো নিচে দিয়ে দিলাম
The Caretaker - Everywhere At The End Of Time - Stages 1-6 (Complete)
A Pesistence of Memory by William Utermohlen
Full project- Everywhere at The End of Time
Can You Name One Object In This Photo?
The Darkest Album I Have Ever Heard - Everywhere at The End of Time - A Bucket of Jake
No comments:
Post a Comment