Pages

Wednesday, June 28, 2017

প্রস্তুতি

খুবই জ্ঞানী, দার্শনিক বা বোদ্ধা কোন মানুষের কথা শুনলে আমরা কী ভাবি? ওই যে মোটা ফ্রেমের চশমা, ব্যাকব্রাশ করা সাদা ধবধবে চুল, হাতে একটা বই,কিংবা খবরের কাগজ নিয়ে ইজি চেয়ারে বসা, পাশে হয়ত এক কাপ গরম চা...। আমার নানু ছিল ঠিক এই বর্ণনার একজন উৎকৃষ্ট প্রতিরুপ। যা যা লিখলাম তা সবকিছুই তার বৈশিষ্ট্যও বটে। সেই ছোটবেলা থেকেই নানু সম্পর্কে এই অবয়বটাই মনের মধ্যে গেথে গেছিল -বনেদি, দার্শনিক লেভেলের একটা লোক, ঠিক যেমন নাটক সিনেমায় দেখা যায়।

একটা বাঁশের লাঠি কয়েকদিন আগ পর্যন্তও ছিল নানীবাড়িতে, পেলা দিয়ে পুরানো আমলের খিল দেয়া দরজা বন্ধ করে রাখার জন্য, যে লাঠি দিয়ে ছোটবেলায় নানু আমাকে আর আমার মামাত ভাইকে ভয় দেখাত। আর খুবই শুদ্ধ, অনেকটা ওপার বাংলার আঞ্চলিক টানে বলত, "এবারে আমি তোদের...!", "নাহ, এদের নিয়ে আর পারা গেল না"। তার কথাবার্তা শুনলে কেউ হয়ত বলতে পারত না তিনি এত সাধারন মানুষ, এতটাই পরিশুদ্ধ ছিল তার প্রতিদিনের কথা বলার ধরন। নানীবাড়ির নুন ধরা পুরানো মোটা দেয়ালগুলোর মতই প্রাচীন ছিল নানু। মানুষটা এতটাই বনেদি ছিল যে কখনো তাকে ব্লেড, কিংবা নেইল কাটার দিয়ে নখ কাটতে দেখিনি, সারাজীবন নরুণ দিয়েই নখ কেটে গেল। এখনকার অনেকে জানেই না নরুণ কি জিনিস! নানুর বিছানার তোষকের তলেই থাকত এক ডেক তাস। অবসর সময়ে, কখনো রেডিও ছেড়ে, কখনও টিভিতে ডিডি ওয়ান চ্যানেল ছেড়ে একমনে তাস খেলত নানু। আর তার ছিল একখানা ইজি চেয়ার, যেটা বারান্দায় পাতা থাকত (যদিও ওইটা বেশীরভাগ সময় আমার আর আমার মামাত ভাইয়ের দখলেই থাকত)। নিজের সিগারেট নিজেই বানাত নানু, এজন্য নানীবাড়ি ভর্তি হরেক রকমের 'ফ্লাইং ডাচম্যান' এর কৌটা পাওয়া যেত সবসময়। কিন্ডারগার্টেন পর্যন্ত ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছি আমি, আমাদের 'সায়েন্স' পড়তে হত। খুবই প্রাথমিক লেভেলের পড়া, যে কেউই পড়াতে পারত, অথচ ছোটবেলায় আমি নানু ছাড়া কারও কাছে এটা পড়তে নারাজ ছিলাম। আমার ধারনা ছিল, নানু ছাড়া কেউ আমাকে এটা পড়ালে ভুল পড়াবে। নানু ছিল আমার প্রথম বিজ্ঞান শিক্ষক। বৃষটি কিভাবে হয়, বীজ থেকে চারা কিভাবে হয় বোঝানো থেকে শুরু করে হোমওয়ার্ক করানো, অভ্র কেমন দেখতে তার স্যাম্পল এনে দেখান, সবকিছুই নানু অনেক উতসাহের সাথে করত।  নতুন কিছু জানার থাকলেই মনে মনে টুকে রাখতাম, নানুকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। মজার ব্যাপার হল, সেই ছোটবেলা থেকেই আমার দেখা সবচেয়ে বুড়া এই মানুষটা ছিল একই সাথে আমার দেখে সবচেয়ে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। তখন থেকেই অবচেতনভাবে একটা ইচ্ছা মনের মধ্যে বাসা বাধতে শুরু করে - আমার চালচলন, কথাবার্তা, চিন্তা চেতনা যেন এই মানুষটার মত হয়। মাঝে মাঝে নানু আমাদের বাসায় থাকত। সেসব দিনে ঘুম থেকে উঠে আমি আর নানু একসাথে 'স্কুবি ডু' কিংবা 'জোসি অ্যান্ড পুসিক্যাটস' দেখতাম। আরো একটা কারটুন ছিল, 'হাইডি অফ দি আল্পস', এইটা আমার আর নানুর খুবই পছন্দের ছিল। আস্তে আস্তে কারটুন বদলে তার স্থান নিতে থাকল ডিসকভারি ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল এর ডকুমেন্টারি গুলো। আমার এই  দুটা চ্যানেল দেখার হাতেখড়ি নানুর কাছেই। নানু সিনেমা হলে চাকরি করত। সেই সুবাদে ছেলেবেলার একটা বিশাল সময় কেটেছে রাজশাহীর উপহার সিনেমা হলে। প্রজেক্টার রুম এ বিশাল বড় প্রজেক্টার মেশিন এর সামনে বসে থাকতাম। এই যন্ত্রটার প্রতি  ছিল অশেষ কৌতুহল। প্রায় প্রতিদিন অফিস শেষে আমাদের বাসায় আস্ত নানু, সেই চিরায়ত পোষাকেই - সাদা পাঞ্জাবী, পায়জামা, আর শীতের দিনে খদ্দেরের শাল। পরে অবশ্য এর সাথে যোগ হয় ওয়াকিং স্টিক, যা তার অলরেডী দার্শনিক লুকটাকে আরো প্রখড় করে তুলেছিল।

ঘোড়ামারাতে নানুর ছিল বিশেষ সম্মান, সবাই তাকে এক নামেই চিনত। স্বর্ণকার পট্টির দোকানগুলো ছিল তার আড্ডাখানা। নানীবাড়ির একটা রুম ভাড়া দেয়া ছিল প্রশান্ত কুমার সাহা কে, যিনি ওখানে রূপম প্রেস নামক একটা ছাপাখানা চালাতেন। প্রশান্ত কুমার সাহাকে আমরা প্রেসের দাদা বলেই চিনতাম, এখনো এভাবেই ডাকি। নানুর কাছে প্রেসের দাদার ঘন ঘন আসা যাওয়া ছিল। দুজন এক হলেই চায়ের কাপ সমেত শুরু হত আলোচনা - সে কি তুখোড় আলোচনা! যেন এক্ষুনি দুইজন মিলে কোন একটা রেভলিউশন লিড করে ফেলবে! আর নানীবাড়ির সামনে যে হিন্দুবাড়িটা ছিল, তার কর্তা আমার নানু নানীর অনেক ঘনিষ্ট ছিল, নানু নাকি মুক্তিযুদ্ধের সময় উনার মাকে অনেক সাহায্য করেছিল।

কখনো ভাবিনি বুড়া মানুষরা আরো বুড়া হতে পারে। কিন্তু নানুও আস্তে আস্তে কীভাবে যেন আরো বুড়া হয়ে গেল। সাথে যোগ হল লাঠি। বই, রেডিও, খবর, আর ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চলতেই থাকল। সুবিধার জন্য আমার দুই মামা নানুকে রিমোট কন্ট্রোল টিভি কিনে দিল। সেই টিভির ঘরেই চলত আড্ডা। আমরা আর আমার খালারা প্রায় প্রতিদিন রাতেই নানীবাড়ী যেতাম। নানু মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে যেত আমাদের গলার আওয়াজে টিভির শব্দ শোনা না গেলে। এইত কদিন আগের কথা, বিয়ার গ্রিলস এর শো টা আসল না মঞ্চায়িত, এ নিয়েও আমার আর নানুর কত আলোচনা হল! আলচনার টপিক গুলাও খুবই মজার হত, বড়ই অবস্কিউর সব জিনিস - কন্সপিরেসি থিওড়ি, চন্দ্রাভিযান, ইউ এফ ও কন্সপিরেসি, ধর্মীয় সব বিতর্ক...। যে সব প্রসঙ্গ তুললে অন্য মানুষজন সন্দেহজনক চোখে তাকাতো, আমি আর নানু সেই সব বিষয় নিয়ে অবাধে আলোচনা করে যেতাম ঘন্টার পর ঘন্টা।

যেদিন নানু স্ট্রোক করলো, সেদিন আমি ঢাকায়। খবর পেয়ে ছোটমামাদের সাথে বাসে যখন আসছিলাম, নানুর অবস্থা তখন ভাল না। সেদিন অনেক ভয় পেয়েছিলাম। পুরা যাত্রা আমি একটা জিনিস ভাবছিলাম - মানুষ যতই বৃদ্ধ হোক বা অসুস্থ হোক, মৃত্যু এমন একটা পরিনতি যার জন্য কখনোই প্রস্তুত থাকা যায় না। সেই যাত্রা নানু বেচে গিয়েছিল, পুরাপুরি সুস্থও হয়ে গেছিল। কিন্তু বেশিদিন ভাল থাকা হয়নি। ধীরে ধীরে ডিমেনশিয়া নানুকে একদম নিঃশেষ করে দেয়। সবকিছু আস্তে আস্তে ভুলেযায় নানু, শেষ পর্যন্ত কাউকে চিনতেই পারত না। হাত পা, শরীরের উপর আর কোন নিয়ন্ত্রন ছিল না। ছিল শুধু ব্যাকব্রাশ করা এক মাথা সাদা চুল।

নানুর জন্মদিন ছিল ২৫শে জুন। এই বছর অবস্থা ভাল না দেখে সবাই তখন রাজশাহীতে। ২৫ তারিখ বড়মামা কেক নিয়ে আসলো। নানুর জন্মদিন পালন করা হবে। নানু তখন একেবারেই বিছানাগত, হাতে স্যালাইনের সূচ ফুটানো। রাত ১১.৪৫ এর দিকে আমি তখনও বাইরে, পরদিন ঈদ বলে রাস্তা রাস্তা হেটে আর আড্ডাদিয়ে বেড়াচ্ছি, হঠাত আব্বুর ফোন, নানুর জন্মদিন পালন করা হবে, আমি যেন তাড়াতাড়ি নানীবাড়ি চলে আসি। নানীবাড়িতে সবাই ছিল তখন। পরদিন ঈদ, সবাই একসাথে। নানুর জন্মদিন করা হল, আমরা কেক কাটলাম। অথচ কেক পুরাপুরি খাওয়াও হল না, পাশের রুম থেকে ডাক পড়ল। ১২.১৫ এর দিকে নানু সবাইকে ছেড়ে চলে গেল। ৯৪ বছরটা আর পুর্ণ করা হল না।

অনেক কষ্ট পেয়েছিল নানু। শরীর পুরা হাড্ডিসার জড় বস্তু হয়ে গেছিল। কোনকিছুই নিজে করতে পারত না। পুরা শরীরের উপর নিয়ন্ত্রন শুন্য হয়ে যাচ্ছিল। শেষের দিকে বিভিন্ন রোগ বাসা বাধে তার অপুষ্ট শরীরে। শেষ কয়দিন ধরে অবস্থার অবনতি ঘটছিল, আমরা অনেকটাই বুঝতে পারছিলাম কি হবে। এজন্য কান্নাকাটি কিংবা শোকের মাতম এতটা ছিল না, সবাই প্রস্তুত ছিলাম। অথচ এই আমিই কয়দিন আগে বাসে বসে ভেবেছিলাম মৃত্যুর জন্য নাকি কখনোই প্রস্তুত হওয়া যায় না। এসব ভেবেই ঈদের দিন পার হল।
অন্যরকম ঈদ।
সবাই যখন ঈদের নামায শেষে কোলাকুলিতে ব্যস্ত, আমরা তখন বরফ খুজে বেড়াচ্ছি, লাশ টিকিয়ে রাখতে হবে। দুপুরে সবাই যখন বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি দাওয়াত খেয়ে বেড়াচ্ছে, আমরা তখন নানুর কবর খুজতে ব্যস্ত।

নানুর চেহারার মধ্যে যে দার্শনিক ভাবটা ছিল, তা শেষ পর্যন্তই ছিল। মৃত্যুর পর তাকে যখন গোসল করিয়ে চোখে সুরমা পরিয়ে দেয়া হল, তাকে একদম ইজিপশিয়ান রাজকীয় ফেরাউনের মত লাগছিল! ভেবেছিলাম ছবি তুলে রাখব, কিন্তু সাহসে কুলায়নি। আর ছিল মাথাভর্তি ব্যাকব্রাশড সাদা চুল!

আমার দেখা সবচেয়ে জ্ঞানী, বিচক্ষন, মুক্ত-মনা, প্রগতিশীল এবং বিবেকবান মানুষগুলার মধ্যে নানু একজন। আজকাল তো এইসব উপাধি অনেকের নামের আগেই দেখা যায়, কিন্তু নানু প্রকৃত অর্থেই এই বিশেষণগুলোর অধিকারী। এইটাই তার জীবন থেকে শেখার সবচেয়ে বড় শিক্ষা। কখনও আপোষ করেনি নানু। সেই উন্মত্ত যৌবনের সময়টাতে, যখন কারো কোন কথাই গায়ে মাখতাম না, কিছুতেই আমার কিছু হত না, নানুর একটা কথাই আমি পুরা চুপ হয়ে যাই, আমার সমস্ত অগ্রাহ্যের দেয়াল ভেঙে পড়ে। অন্যমনস্ক হয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে নানু ওইদিন বলেছিল, "তোকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন রে অয়ন..."। নানু আমাকে অনেক ভালবাসত। জীবনের শেষ দিকে এসে প্রলাপ করত যখন, কাউকে চিনতে পারত না, তখনও অয়ন পরিচয় দিয়ে সামনে হাজির হলে একরাশ হাসি নিয়ে বলত, "ও! তুমি অয়ন! তোমাকে তো আমিই পড়ালেখা করালাম, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করালাম"।
এত বড় মানুষের স্বপ্ন পূরণ করতে পারাটা অনেক কঠিন কাজ।কতদুর কি করতে পারবো কে জানে?
স্বান্তনা এইটুকুই, নানুর চরিত্র থেকে যা শিখার, তা আমি নিজের মত করে হয়ত শিখে নিয়েছি। সেটা তো গেল আমার কথা, আমরা হয়ত বুঝেই ফেলেছিলাম এরকম কিছু একটা ঘটবে, প্রস্তুত ছিলাম মোটামুটি। কারণ শেষের দিকে নানু অনেকটা না থাকার মত করেই ছিল, কিন্তু নানু যে থাকলো না, এখন নিম গাছটার কী হবে? বাড়ির উঠানটার কী হবে? বইগুলার কী হবে? বই পড়ার ল্যাম্পটার কী হবে? প্রেসের দাদা কার সাথে গল্প করবে?









No comments:

Post a Comment